পুরানো বই বাজার
প্রেসিডেন্সির রেলিং-এ এত পুরোনো বইয়ের দোকান তখন হয়নি। রেলিং-এ কে বা কারা পুরোনো বইয়ের দোকান শুরু করেছিল সে ইতিহাস ঘাঁটবে গবেষকরা, পণ্ডিতরা। আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি, তাই লিখছি। এই-যে আমি দেখেছি বা শুনেছি তার কিছু সাবুদ আমার কাছে আছে।
কলেজ স্ট্রীটের এই রেলিং-এ পুরোনো বইয়ের প্রথম দোকান যিনি করেন তার নাম কল্যাণ মণ্ডল। কিছু বিখ্যাত নয়, অতি সাধারণ মানুষ, ভালো মানুষ, দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষ। শ্রীরামপুরে আসা-যাওয়া ছিল।
উইলিয়াম কেরি প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজের সর্বশেষ সাহেব প্রিন্সিপাল অ্যাংগাস, সেই সময়ে শ্রীরামপুরের ফাদার বললেও ভুল হবে না। ছেলেবেলায় দেখেছি, কখনও সাইকেলে কিংবা পায়ে হেঁটে চলেছেন, মাথায় টুপি, পরনে হাফ প্যান্ট, সবাইকে 'মর্নিং মর্নিং' করে। দেখলে প্রাণটা ভরে যেত। সবাইয়ের তিনি ছিলেন স্যার। শ্রীরামপুরের আমার বয়সে যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা এই স্যারকে কেউ ভুলবেন না, কেউ ভুলতে পারবেন না। অ্যাংগাসসাহেব সারা জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন শ্রীরামপুরকে। শুনেছি তাঁর লন্ডনের বাড়ির নাম ছিল শ্রীরামপুর। এখন শ্রীরামপুরের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ যারা তাদের সঙ্গে এই কল্যাণ মণ্ডলের পরিচয় ছিল। সেই সূত্রে শ্রীরামপুরে তার আসা-যাওয়া। মণ্ডলবাবু থাকত কলেজ স্ট্রীটের কাছেই নিমু খানসামা লেনে। এই মণ্ডলের রান্নার হাত খুব ভাল ছিল, ও অ্যাংগাসসাহেবকে বাঙালি রান্না করে খাওয়াত। চচ্চড়ি, সূক্তো, মোচার ঘণ্ট এইসব খাওয়া ওঁর খুব ভালো লাগত। সেই সূত্রে অ্যাংগাসসাহেবের খুব কাছের মানুষ হতে পেরেছিল।
উইলিয়াম কেরিসাহেবেরও শ্রীরামপুর ছিল জীবনের প্রাণকেন্দ্র এবং দেহও রেখেছিলেন এই শ্রীরামপুরেই। তাই সবাইয়ের একটা ধারণা ছিল অ্যাংগাসসাহেবও ঠিক এই রকমই করবেন। তা হয়নি। অবশেষে অ্যাংগাসসাহেব চলে গেলেন লন্ডনে, শ্রীরামপুরের মায়া কাটিয়ে। ফেলে-দেওয়া জিনিসগুলো বিলিয়ে দিলেন কর্মচারীদের মধ্যে। পরে রইল এক বস্তা ফেলে দেওয়া, কেউ না-নিতে-চাওয়া বই। তখন এই মণ্ডল বলল, 'আমাকে বইগুলো দিন।' এই পুরোনো বই মণ্ডলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। পুরোনো হল নতুন। প্রথম দিন কিছু বই, কিছু ম্যাগাজিন ও জার্নাল প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের রেলিং-এ, সাজিয়ে, কিছু বই ফুটপাতে ফেলে একটা টুলে বসে শুরু হয়ে গেল প্রথম পুরোনো বইয়ের দোকান।
প্রথম দিনই সব বই সেল। তারপর মাঝে মাঝে গোরা পুলিশের হুজ্জত, আরও নানান অসুবিধা সব কাটিয়ে হয়ে গেল "মণ্ডল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি"। প্রথম পুরোনো বইয়ের দোকান।
শ্রীরামপুর কলেজের সামনে গঙ্গার ধারে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা আমার রোজের কাজ ছিল। কলেজের কর্মচারীরাও আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। সেই সময়ে সেইখানে এই গল্প শোনা। সব জিনিসের 'প্রথম কে' খুঁজে বার করা খুবই দুষ্কর। কলেজ স্ট্রীটের প্রথম বইয়ের দোকান কোনটা ? কে বা প্রথম ক্রেতা, কে বা প্রথম বিক্রেতা ? জানা কি সম্ভব ? হয়তো সম্ভব। 'এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স' পঞ্চাশ সাল থেকে আমার কলেজ স্ট্রীট দেখার একটি নাম করা পুরোনো প্রকাশক। এর মালিক সুধীর সরকার আমার পরিচিত শ্রদ্ধার মানুষ। তাঁর ভালোবাসা শেষ দিন অবধি পেয়েছিলাম, পেয়েছিলাম তাঁর আশীর্বাদও। তাঁর সম্পাদনায় একটি মূল্যবান বই 'হিন্দুস্থান ইয়ার বুক' সারা ভারতবর্ষে প্রয়োজনীয় বই এবং বিখ্যাত বই। এই বইয়ের প্রচ্ছদ আমি কয়েকবার এঁকেছি। আরও একজন পুরোনো পণ্ডিতকে দেখেছি, ষষ্ঠীচরণ ভট্টাচার্য- তাঁর পরিচালনায় প্রকাশিত হত একটি পুরোনো পঞ্জিকা, 'বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা'- এই প্রাচীন পঞ্জিকার অনেক কাজ আমি করেছিলাম। এখন এই পঞ্জিকার প্রকাশক বসুধারা প্রকাশক।
তথ্য সূত্র : ভালোবাসার আড্ডা ✒️ অজিত গুপ্ত
আনন্দ 🍁 পাবলিশার্স
No comments:
Post a Comment